কার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন আমরা সব সময় বলি আমাদের "দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী"। এই বাহিনী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলস্বরূপ গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর জন্ম হয় এবং তা বিজয় অর্জন, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, মেগা প্রকল্পে অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। গত ১৬ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়েছে, তবে সেনাবাহিনী এখনো আমাদের গর্ব। জুলাই বিপ্লবের পর ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার ছড়ানো হচ্ছে। এসব প্রচারণার লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। প্রতিবেশী দেশের একাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে বিপ্লব ঘটেছিল, তার বিপ্লবীরা এখন কার স্বার্থে এসব গুজব ছড়াচ্ছেন? আমাদের সেনাবাহিনী দুর্বল হলে কার লাভ হবে, তা স্পষ্ট। সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার, গর্ব, কিন্তু কেন এমন বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে? সমাজের প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তির উচিত, বুঝতে হবে, কোথায় গিয়ে থামতে হবে এবং কী করা উচিত। যাদের এই বোধ নেই, তারা কখনোই দায়িত্বশীল নাগরিক, বিপ্লবী বা নেতা হতে পারবেন না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিপ্লব ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধ। যদিও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী ছিলেন এবং দলের অন্য নেতারা ভারতে অবস্থান করছিলেন, তখন মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা বিশ্বকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের বার্তা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের ১০টির কমান্ডার সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, যেখান থেকে রাজনৈতিক নেতাদের কোনো নেতৃত্ব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে বহু প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হলেও, সেনাবাহিনী বরাবরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যা দেশের পরিস্থিতির দিকে মোড় নিতে সহায়ক ছিল।
ক্ষমতা দখলের ঘটনায় সেনাবাহিনীর দুর্নামও হয়েছে, তবে এটা অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। আবার ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সহযোগিতা করেছে, যাতে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯০ সালের ঘটনাটি ছিল সেনাবাহিনীর সহায়তায় গণ অভ্যুত্থান। একইভাবে, জুলাই বিপ্লবের সময়ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে, তবে অনেক অমিলও আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দীর্ঘকালীন সংগ্রাম, যেখানে ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশের সংগ্রাম, যেখানে ৮৩৪ জন শহীদ এবং বহু আহত হয়েছে। যদিও দুই বিপ্লবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তবে ২০২৪ সালের বিপ্লব স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়, বরং ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তির জন্য ছিল।
জাসদ ও এনসিপি’র মধ্যে বেশ কিছু সমান্তরাল বিষয় আছে। ১৯৭১ সালের বিপ্লবের পর জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লবের পর এনসিপি নামে নতুন দল গঠিত হয়েছে। দুটি দলের লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, তবে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা ও কৌশলের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই নতুন দলগুলো এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখার বিষয় হবে, আগামী নির্বাচনে এগুলো দেশের জনগণের সমর্থন পাবে কিনা।
তবে, ইতিহাসে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর ভিতরে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা যারা করেছে, তারা দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে পারেনি। আজ আমরা এমন একটি সরকারে আছি, যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ চলছে। এ সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যাতে সশস্ত্র বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এজন্য দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন, যাতে সেনাবাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করা যায়। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে তিনি সরকারকে সমর্থন দেবেন। এর পরে সরকারের ভিতরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তবে তাঁর অবস্থান এখনও অপরিবর্তিত।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta