সূর্যসন্তানরা কি নিজেদের পথ ভুলে গেছেন?
বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানরা এক অভূতপূর্ব আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, যেখানে কয়েকজন সাহসী তরুণ অসম্ভবকে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন। অনেকেই আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন, এমন মনে হয়েছিল যে বাংলাদেশ চিরকাল স্বৈরাচারের অধীন হবে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধারা নতুন আলো দেখিয়েছিলেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ যেন নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে, তারা অসীম সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে এক শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠন করা হয়। ছাত্র সংগঠনের নেতারা প্রজ্ঞার সঙ্গে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য একজন হিসেবে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। ড. ইউনূস তখন একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন এবং ঘোষণা করেন, জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদেরও উপদেষ্টা মণ্ডলীতে স্থান দেওয়া হবে। এ ছিল একটি চমক।
দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, তরুণরা তাঁদের স্বপ্নের মতো বাংলাদেশ গঠন করবেন। তরুণরা দেশকে নতুনভাবে সাজাবেন এবং সবাইকে পথ দেখাবেন। ইতিহাসে বারবার তরুণরা এ দেশের ইতিহাসের বাঁক বদল করেছেন, যেমন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান, এবং ২৪ সালের বিপ্লব - সবকিছুই ছিল তরুণদের অবদান। তাই রাষ্ট্রে তরুণদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা ড. ইউনূস বাস্তবায়ন করেছিলেন। তরুণ এবং প্রবীণদের মিশ্রণে গঠিত উপদেষ্টা মণ্ডলী বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। দেশবাসী নতুন বাংলাদেশ চেয়েছিল, কিন্তু গত সাত মাসে কিছু তরুণের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস এবং বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে। তারা যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। সাত মাসে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে পড়ে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুলা উপন্যাসের সেই উক্তি, 'পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?' এখন জনগণ মনে করছে, জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানরা কি পথ হারিয়েছে?আমরা জুলাই বিপ্লবের পর দেখেছিলাম, তরুণরা রাষ্ট্র সংস্কার ও দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং অধিকাংশ মানুষ এগুলোকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ কিছু তরুণ রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি তুলেছিল। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে প্রধান ব্যক্তি, এবং তাকে অপসারণের জন্য বৈধ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এটি একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে, এবং শেষে তারা বুঝতে পারে যে এটি সাংবিধানিক পন্থা নয়। এরপর তারা ফিরে আসে।
এরপর ডিসেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি উঠেছিল। তারা ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা করে, যা আবার জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বোঝানো হয় এবং আলোচনার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়নি। এর পর সরকার এটি রাজনীতির মাঠে নিয়ে যায় এবং বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র দেওয়ার বিরুদ্ধে থাকে, যার ফলে এটি রাজনৈতিকভাবে অমীমাংসিত হয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। এটি তরুণদের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি রাখে। তবে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে, বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের নেতাদের মধ্যে একে অপরকে বিরোধিতা করছে। একটি রাজনৈতিক দলের ভিতরে এমন বিভ্রান্তি দলটির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। একটি রাজনৈতিক দলকে শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বশীলভাবে পরিচালিত করতে হয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি দলটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা বিষয়গুলো নিয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করছেন, যা দলটির সামগ্রিক ভবিষ্যত ও জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসা এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারও গুরুত্বপূর্ণ, যা কিছু নেতার দায়িত্বহীন মন্তব্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক
Email : [email protected]
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta