একাত্তর থেকে চব্বিশ : গৌরবময় শহীদ জিয়া
কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় বলেছেন, -‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস, ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, -পেয়েছি, পেয়েছি’। এই কবিতায় হেলাল হাফিজ স্বাধীনতার মূল চেতনা সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি অমূল্য অর্জন। ২৪শে আগস্টের পর এই উপলব্ধি নতুনভাবে অনুভূত হয়। একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে যে বিশাল ত্যাগ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস লেখা হয়েছে, তা প্রকাশ করা সহজ নয়।
২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশ দুটি রাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ভারত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের নতুন করে বাঙালিদের শোষণ ও পরাধীনতার চেষ্টা। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪৮ সালে বাংলা ভাষার দাবি, ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের জয়, ৫৬-তে সংবিধান প্রণয়ন আন্দোলন, ৫৮-তে মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন, ৬২-তে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-তে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮-তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এ গণ অভ্যুত্থান; সব শেষে আসে ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, যখন স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। তারা জানত না যে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রকৃতি তার শূন্যস্থান পূরণ করে, সেটা সময় বা মানুষ হতে পারে। মার্চ ২৫ কালরাতে মুজিবের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে আসেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২৫ মার্চ রাত ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। চট্টগ্রামে সে সময় উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। অস্ত্রবোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় এবং রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ ১০টা পর্যন্ত চলে। রাত ১১টায় চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া মেজর জিয়াকে একটি কোম্পানি নিয়ে বন্দরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর মেজর জিয়া অফিসার ও সৈন্যদের একত্রিত করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, আনুমানিক রাত ২টা ১৫ মিনিটে স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘ডব জবাড়ষঃ’। উপস্থিত সঙ্গীদের সামনে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়া যান। বেতারকর্মীরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি কিছু সময় বিবৃতি লেখার পর তা ছিঁড়ে ফেলেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রস্তুত করেন। ওই ঘোষণা ইথারে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতারে প্রচারিত হয়। এর ফলে সারা পৃথিবী জানতে পারে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের কথা।
মেজর জিয়াউর রহমানের সাহসী সিদ্ধান্ত স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পর সাধারণ মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেন। যদি তিনি সেই দিন ‘উই রিভোল্ট’ না বলতেন, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এখন অনেকেই তাঁর সেই সাহসিকতা ও স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। একটি স্বাধীন দেশ গড়ে ওঠে এবং ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড লাল-সবুজের পতাকায় শোভিত হয়। এর পর জিয়াউর রহমান সামরিক ব্যারাকে ফিরে যান।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যদি স্বাধীনতা অর্জিত না হতো, তাহলে জিয়াউর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো। তাঁর ডাকেই লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধের মাঠে নেমেছিল। জিয়াউর রহমান সেই ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। রাজনৈতিক গবেষকরা বলেন, ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার হওয়ার পর মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি ছিল। তাঁর ভাষণে স্বীকৃতি পাওয়া গেছে মার্কিন সিআইএ-র গোপন দলিলেও।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর মেজর জিয়া যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে। পরবর্তী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মোরারজি দেশাইও তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন।
এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বলেছেন, ‘শেখ মুজিব এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি শান্তিপূর্ণ সমাধান চান।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ক্ষমতায় আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। তবে যুদ্ধের বাস্তবতা বুঝতে পারলেন না। তাঁর শাসনামলে দেশে দুর্নীতি, শোষণ ও নির্যাতন শুরু হয়। পরে তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন, মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে দেশ সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যায়।
জিয়াউর রহমান এখানে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে নানা উদ্যোগ নেন। তাঁর সবুজ বিপ্লব কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। তিনি বাংলাদেশকে একটি অগ্রগামী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta