বিপ্লব থেকে দলীয় রাজনীতি
ছাত্রজীবনে আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছি। প্রতিবারই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বাধা এসেছে, কিন্তু কখনো পিছু হটিনি। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের গণপ্রতিরোধে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। এর ফলে নতুন এক বাংলাদেশ গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা এগিয়ে নিতে নতুন দলে যুক্ত হয়েছি। আমাদের পথচলা মাত্র শুরু, তাই চ্যালেঞ্জ থাকবে জেনেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। যে নতুন দেশ পেয়েছি, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলতে চাই। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ যেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
আমার রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি ছাত্রজীবনে। ঢাকায় বেড়ে ওঠার ফলে বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী হিসেবে শুরু থেকেই ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। প্রথমে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কর্মী হিসেবে কাজ করলেও পরে দলীয় রাজনীতি ছেড়ে যৌথ ছাত্রআন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ও ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ এর অন্যতম সংগঠক ছিলাম। ২০১১-২০১৮ পর্যন্ত বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিই।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেই, মেট্রোরেল প্রকল্পের বিরোধিতা, তনু হত্যা প্রতিবাদ ও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করি। ২০১৬ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করি, যা আলোচিত হয়। এছাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মঞ্চ ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ তে যুক্ত ছিলাম। হল প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় ও ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখ্য ভূমিকা পালন করি।
২০১৮ সালে ঢাবির যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলাম। ২০১৭ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের সময় সিন্ডিকেট ভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নিই এবং হামলার শিকার হই। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করায় ২০১৪-২০১৮ সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি পাই।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে কিছুদিন চাকরির পর আবারও আন্দোলনে সক্রিয় হই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদসহ বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। রাষ্ট্র সংস্কারের তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ সংগঠনের সঙ্গে কাজ করি। জুলাই অভ্যুত্থানে মাঠে ছিলাম এবং পরে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র মুখপাত্র হই। বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী পথচলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকার ফলে আন্দোলনের ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে দেশ গঠনের সুযোগ এসেছে। প্রচলিত রাজনীতির ধারা বদলে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, ১৫ বছরের দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত হয়েছি, এখন দেশকে বদলানোর, তরুণদের স্বপ্ন দেখানোর সময়।
দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এসেছি, প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমাদের অনেকের লড়াই স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিরোধের ইতিহাস। রাজনীতিতে এটি আমার দায়িত্ব। সাধারণত ক্ষমতা হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্বকে দেখা হয়, কিন্তু আমরা এটিকে দায়িত্ব হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামোয় বন্দী ছিল, যা পুরোপুরি জনবিরোধী। এই কাঠামো পরিবর্তন করা এখন সময়ের দাবি। জুলাই আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি চার দশক ধরে বিএনপি-আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন নাগরিক পার্টি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আমরা চাই, বাংলাদেশ সত্যিকারের আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে উঠুক। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য কোনো দলই সঠিক পরিকল্পনা নেয়নি। প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সে অবস্থানে যেতে পারেনি।
বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিসরে দুর্বল। এজন্য রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, যেখানে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। তরুণদের মূল্যায়ন করতে না পারলে আমরা ব্যর্থ হব। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আমরা চাই বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, যেন একচ্ছত্র আধিপত্য না থাকে। দক্ষতা ও যোগ্যতা রাজনৈতিক দলগুলোর মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। আমাদের লক্ষ্য, সংসদে এই পরিবর্তন প্রতিফলিত করা।
গণপরিষদ নির্বাচন এখন জরুরি। সংবিধান পরিবর্তন প্রয়োজন—এটি অস্বীকার করা যাবে না। যদি বর্তমান সরকার তা না করে, তবে আমরা এসে করব। এবার থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হওয়া দরকার। কারণ, বাংলাদেশ তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন দেখেছে, আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন মানুষ সহ্য করবে না। আগামী নির্বাচন অবশ্যই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে, যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন দিক উন্মোচন করবে।
লেখক: সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিসি)।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta