এক অজ্ঞাত আতঙ্ক মিডিয়ার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে
সাংবাদিকদের বিবেক জাগ্রত না হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষ ভুল করতে পারে, কিন্তু ইতিহাস নয়। আমাদের রাজনীতিবিদরা যেমন অতীত ভুলে যান, অনেক সময় আমরা সাংবাদিকরাও তাই করি...
সর্বত্র অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে—রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সবখানেই এক পরিস্থিতি। আমরা জানি, যেখানে ন্যায়বিচার আছে, সেখানেই বিজয়। কিন্তু দেশে এখন ন্যায়বিচার দুর্লভ। এক সময় ছিল টেলিফোন জাস্টিস, আর এখন মব জাস্টিসই প্রাধান্য পাচ্ছে। মিডিয়া এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রতিনিয়ত এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের এই প্রবণতা মিডিয়ার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে মিডিয়া অনেকাংশে নিশ্চুপ, মাঝেমধ্যে সরব হওয়ার চেষ্টা করলেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। কেউ সরাসরি নির্দেশ দেয় না, ফোনও করে না—কোন খবর যাবে, কোনটা যাবে না। আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেই, মুখ খুলতে পারি না। লিখতে গেলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দৃশ্যমান শক্তির পাশাপাশি অদৃশ্য প্রভাবও কাজ করছে। কেউ প্রতিবাদ করতে রাজি নয়, কেউ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়ায় না, নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না। মিডিয়াকর্মীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্বে থাকা সংগঠনগুলোও নিশ্চুপ। এমনকি, অনেকেই ভুলে গেছেন যে একসময় এসব প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়ে দিশেহারা, কারও কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানালেও, তা যথেষ্ট নয়।
আমরা একসময় সংবাদ প্রকাশের প্রতিযোগিতায় ছিলাম, কিন্তু এখন এক অজানা শঙ্কা আমাদের পেছনে টেনে ধরছে। টকশোতেও বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস নিয়ে নতুন বিতর্ক শোনা যাচ্ছে। দলীয় কর্মীদের পাশাপাশি অনেক মিডিয়াকর্মীও আত্মগোপনে চলে গেছেন, কেউ কেউ কারাগারে, কেউ আবার দেশ ছেড়েছেন। এর মধ্যেই কিছু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে। সাংবাদিকদের ওপর আস্থা কমছে। বিভাজন ও অজানা ভয় মিডিয়ার অস্তিত্বকে সংকটে ফেলেছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক—সব মাধ্যমই নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই অবস্থার সৃষ্টি একদিনে হয়নি, বরং দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। স্বাধীনতার পরও সাংবাদিকদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সামরিক শাসনের সময় ছিল নীরবতা, পরে এলো নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, যেখানে স্বাধীনতা সীমিত ছিল। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে আমরা মিডিয়ার স্বাধীনতা ভুলতে বসেছি। জনগণের সামনে নিজেদের আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়েছি, কিন্তু লজ্জা পাইনি। আজ এরই মূল্য চুকাতে হচ্ছে।
বর্তমানে সত্য সংবাদ অনুসন্ধানের আগ্রহ কমে গেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। অনেকে এর পেছনে উদ্দেশ্য খোঁজেন, বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দেন। ফলে কেউ আর সত্যের গভীরে যেতে চায় না। মিডিয়া হাউসগুলো সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে, যদিও তা যৌক্তিক নয়। বিভিন্ন ডিজিটাল ও সাইবার আইনসহ নানা বিধিনিষেধ মিডিয়ার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি কি সম্ভব? কেউ কেউ বলেন, রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকলে দ্রুত পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু মনে হয়, সাংবাদিকদের বিবেক না জাগলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমরা বারবার একই ভুল করি। স্বাধীন দেশের সাংবাদিকতা এখানে কখনোই পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। এর জন্য শুধু রাজনীতিবিদদের দায়ী করলে চলবে না। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির কারণ হয়েছি। অন্যের কণ্ঠ রোধের খবর শুনে আনন্দ পেয়েছি, আবার কোথাও গিয়ে বলেছি—এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta