‘নতুন আতঙ্কে দেশজুড়ে উদ্বেগ’, সাবেক আমলাসহ অনেকেই আতঙ্কিত
‘মব জাস্টিস’ এখন এক নতুন ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংঘবদ্ধ জনগণের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে অপরাধবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘মব জাস্টিস’ বলা হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে এই নামে কাউকে মারধর, লুটপাট এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। কোথাও জোর করে কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা হচ্ছে। দিনে দিনে এমন বিচারবহির্ভূত সহিংস ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণির মানুষ এ রকম সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মব জাস্টিসের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তারা মনে করছেন, আগের সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ এবং দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আজকের এই সহিংসতার রূপ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে আইন নিজের হাতে নেওয়ার ঘটনা সীমিত ছিল চোর-ডাকাত পেটানো পর্যন্ত, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশ, শিক্ষক, উপাচার্যদের মারধরে। কোথাও আদালত চত্বরে আসামির ওপর হামলা হচ্ছে, কোথাও খুন হচ্ছে মানুষ। শিল্প কারখানা, মাজার, ভাস্কর্যেও হামলা চালানো হচ্ছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এসব ঘটনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
প্রথমদিকে নীরব থাকলেও এখন সরকার মব জাস্টিস নিয়ে সক্রিয়। তারা এসব ঘটনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং কেউ সরকারকে বিব্রত করতে এ ধরণের ঘটনার পেছনে আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে ঘিরে সংঘটিত ঘটনায় সরকার বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বেআইনি, এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি। ওই ঘটনায় উত্তরা থানা পুলিশ ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এই প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনীতির বাস্তবতা ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে এই ধরনের সহিংস ঘটনা। তবে যত ক্ষোভই থাকুক, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং যারা এই কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে।
নুরুল হুদাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর অনেক সাবেক আমলা আতঙ্কে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, যারা অতীতে সরকারের নির্দেশে কাজ করেছেন, তারাও যেকোনো সময় মবের টার্গেট হতে পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক সচিব বলেন, ‘আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করেছি, এতে যদি মবের শিকার হতে হয়, তাহলে সম্মানের আর কিছু থাকে না। বিচার হোক আইনের মাধ্যমে, এই স্বৈর-শাস্তির পথ বন্ধ করতে হবে।’
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আত্মগোপনে গেছেন, কেউ দেশে, কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও দলটির সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক জায়গায় মবের হাতে নির্যাতিত হওয়ার পর আওয়ামী নেতাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে তুচ্ছ গুরুত্বের নেতারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে বারবার বক্তব্য দেওয়া হয়েছে এবং কর্মীদের সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কেউ যদি দলের হয়ে মবের ঘটনায় জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আমরা মব সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি না।
বিএনপির আরেক নেতা রুহুল কবীর রিজভী বলেন, যতো বড় অপরাধীই হোক, তার বিচার আইনের মাধ্যমেই হতে হবে। গত কয়েকটি নির্বাচন ছিল শেখ হাসিনার একক নাটক, যাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হয়েছে তারাও অপরাধে জড়িত হলেও মবের শিকার হওয়া উচিত নয়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গ্রেপ্তার ও হেনস্থার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকার মবের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও প্রশ্ন উঠেছে— এই মব সংস্কৃতি তৈরিতে কি সরকারেরও ভূমিকা নেই?
তিনি আরও বলেন, যতদিন সরকার সুষ্ঠু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হবে, ততদিন মবোক্রেসি বন্ধ হবে না। সরকারের ব্যর্থতাই বারবার মব জাস্টিসের ঘটনাকে উসকে দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২২ জুন সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে তার বাসা থেকে আটক করা হয়। আটকের আগে একদল লোক তার বাসায় ঢুকে অপদস্থ করে এবং লাইভ সম্প্রচারে জুতার মালা পরায়।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta