অশান্তিতে আছি, এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: উমামা ফাতেমা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। শুক্রবার (২৭ জুন) রাতে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিনি তার এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেন। তিনি সংগঠনটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, অনৈতিকতা এবং বিশৃঙ্খলার অভিযোগও উত্থাপন করেন।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘গত পরশু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটাই ছিল এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রার শেষ দিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলের গঠনের পর, অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করার দায়িত্ববোধ থেকে আমি এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু এই ব্যানার স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তাই আমার ওপর বিভিন্নভাবে অনলাইন এবং অফলাইনে চাপ প্রয়োগ করা হয় যাতে আমি এই প্ল্যাটফর্মে কাজ না করি। আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ব্যানারকে সচল রাখার চেষ্টা করেছিলাম। পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। যাদের সঙ্গে একত্রে মিছিল-মিটিং করেছি, তারাই পরিকল্পিতভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। এই সহযোদ্ধারাই প্রয়োজনে মানুষকে ব্যবহার করে আবার প্রয়োজন ফুরালে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মার্চ-এপ্রিলে কাজ করার সময় আমি দেখেছি প্ল্যাটফর্মটি অভ্যন্তরীণভাবে স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা আক্রান্ত। হ্যাঁ, কিছু ভালো মানুষও ছিলেন যারা কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারাও সুবিধাবাদীদের কারণে জায়গা পাননি। আমি এখনো ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলি, সহযোগিতার চেষ্টা করি।’
জুলাই আন্দোলনের এই নেত্রী আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মতো বিশাল এক ঘটনার পর সবকিছু ধসে পড়তে দেখা খুবই কষ্টকর ছিল। পরে শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আমি নিজেকে ব্যানার থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। যদিও আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ করিনি, কার্যত এপ্রিল-মে থেকেই প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে ছিলাম। আমি Empowering our Fighters প্রকল্পে মনোযোগ দিই, বিজ্ঞানভিত্তিক কাজেও যুক্ত হই। অনেকবার পদত্যাগপত্র লিখেও জমা দিতে পারিনি। আবেগের কারণে থেমে গেছি। আমি এই প্ল্যাটফর্মে এসেছিলাম দেশ পরিবর্তনের আশায়, কাদা ছোড়াছুড়ির জন্য না।’
ফাতেমা আরও উল্লেখ করেন, ‘জেলা ও উপজেলার অনিয়মের খবর আসত, সাংবাদিকদের ফোন আসত। আমি বলতাম— যারা এই কমিটিগুলো বানিয়েছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনুন। কমিটি নিয়ে আমার আপত্তি থাকলে আমি তা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে জানিয়েছি। এনসিপি গঠনের আগে অপরিকল্পিতভাবে কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা কিছু আপত্তি তুললেও সেগুলোর কোনো জবাব পাইনি। মুখপাত্র হিসেবে আমার পেইজের অ্যাক্সেস থাকার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি, বরং মার্চ মাসে উল্টো আমার বিরুদ্ধে পোস্ট করা হয়। আমি যখন ব্যবস্থা নিতে যাই, তখন পেইজ ব্যবহার হয় আমার বিরুদ্ধে। দিনের পর দিন আমাকে অপমান করা হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। যারা পাশে থাকার কথা, তারাই অন্য পথ খুঁজত। আমার কথা বলার সময় সহমত দেখালেও, রাতে হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবি নিয়ে দরকষাকষি করত। এসবের খবর আমার কাছে আসত। যখন মুখোমুখি হতাম, তখন বলা হতো— আমিও যেন হেয়ার রোডে গিয়ে পদ নিয়ে আসি। আমি জিজ্ঞাসা করতাম— ওরা কে আমাকে পদ দেবে? আমি কেন ওদের কাছে যেতে যাবো? এসব ভাই-ব্রাদার রাজনীতির কারণে প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ হয়ে আছে। আমি কাজ করতে চাইলেও দিত না। বরং গুজব ছড়ানো হতো যে আমি কাউন্সিল আটকে রেখেছি। নেতারা জুনিয়রদের দিয়ে ফোরামে প্রোপাগান্ডা চালাত। আমি শেষমেশ নির্বাহী কমিটির সদস্যদের জানাই এবং মুখপাত্র পরিচয় ছেড়ে শিক্ষার্থী পরিচয় গ্রহণ করি। এরপর শুনতে পাই যে আমি নাকি কাউন্সিল আটকে রেখেছি, অথচ সবাই জানে কাউন্সিল আটকে ছিল মন্ত্রীপাড়ায়। আমি তখন আর এই প্ল্যাটফর্মে ছিলাম না। আমার নীরবতা নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছে। অথচ আমি নিজেই কোনো শাখা কমিটির বিষয়ে একশন নিতে পারিনি। এমনকি পেইজ থেকে পোস্ট হওয়া উপজেলা কমিটিগুলোও বন্ধ করতে পারিনি। অথচ হেয়ার রোড থেকে আহ্বায়ক আসার পর ২০ দিনের মধ্যে নির্বাচনও হয়ে গেছে।’
ফাতেমা আরও বলেন, ‘সবশেষে ছিল কাউন্সিলে ভোট দেয়া। আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। কারণ যাদের কাজ করার আগ্রহ ছিল, তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগই পায়নি। ভোটার সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত এবং বেশিরভাগই একটি রাজনৈতিক দলের লোক। জুনিয়ররা এসে আমাকে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিল। আমি শেষ মিনিটে ভোট দিয়ে আসি— শেষ মুহূর্তে কিছু ভালো কিছু করার আশায়। নির্বাচনে কিছু প্রার্থী সত্যিই কাজ করতে চেয়েছিল, আমি তাদের সমর্থন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর দেখি, একজন যিনি নির্বাচনেই অংশ নেননি তিনিই সদস্য হয়েছেন। এসব দেখে আমি অত্যন্ত বিব্রত। একই স্বেচ্ছাচার, স্ট্যান্ডবাজি আর ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা। এখন মনে হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যত অন্ধকার।’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের কথা মাথায় রেখে আমি প্ল্যাটফর্ম থেকে সব ধরনের সমর্থন ও আমার দেয়া ভোট প্রত্যাহার করছি। আমি গভীর অশান্তিতে আছি। অভ্যুত্থান যেমন আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, এই প্ল্যাটফর্ম অনেকের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পেয়েও মুখপাত্র হিসেবে গিয়ে বুঝি সংস্কার, জুলাই, শহীদ— এসব শুধু কথার বুলি। শুধু আমি না, অনেকেই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সবার সাথেই প্রতারণা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, নোংরামি করেছে, অভ্যুত্থানকে পণ্য বানিয়েছে— আমি তাদের কখনো ক্ষমা করব না। আমি অন্তর থেকে তাদের জন্য বদদোয়া করি। চাইলে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অনেক মানুষ হারিয়েছে, পরিবার ভেঙে গেছে। আমি এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। এখন আমি সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোতে চাই। অনেক ভালো, সদিচ্ছাসম্পন্ন মানুষও আমি এই প্ল্যাটফর্মে দেখেছি। আমি সবাইকে বলব— পড়াশোনায় মন দিন, কাজের দিকে মনোযোগ দিন। আমিও ভেঙে পড়ছি না, সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। ফি আমানিল্লাহ।’
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta