জুলাই অভ্যুত্থানের অজানা চিত্র
আন্দোলনের নেপথ্যে থেকে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও সমর্থন দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন, তাদের নাম অনেক ক্ষেত্রে অজানাই থেকে গেছে...
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে, যা পরে এক দফা দাবির রূপ নেয়। দেশপ্রেমী ছাত্ররা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়। তারা অতীতেও ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এসব আন্দোলনে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা ইতিহাসের পাতায় স্বীকৃতি পেলেও নেপথ্যের অবদান রাখা ব্যক্তিরা চিরকাল অন্তরালে থেকে গেছেন।
অনেকেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেননি, তবে আড়ালে থেকে বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা ও সহায়তা দিয়েছেন। ইতিহাসে তাদের নাম না থাকলেও সাধারণ জনগণের মনে তারা অমর হয়ে আছেন।
জুলাই বিপ্লবে আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাই। আন্দোলনের নেতারা উপদেষ্টা হয়েছেন, রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু যারা তাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে ছিলেন, তারা রয়ে গেছেন আড়ালে। বিশেষত, চট্টগ্রামে আন্দোলনের এক ভয়াবহ দিনে যখন পুলিশ ও সরকারপন্থী সংগঠনগুলো আন্দোলনকারীদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায়, তখন সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে বিপদগ্রস্ত ছাত্রদের রক্ষা করেন।
৪ আগস্ট চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলার পর ছাত্ররা দিগ্বিদিক ছুটতে বাধ্য হন। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা তাদের নির্মমভাবে আক্রমণ করে। আহত ছাত্ররা আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় খুঁজতে থাকে। এমন সময় স্থানীয় এক মমতাময়ী মা কয়েকজন ছাত্রকে তার বাসায় আশ্রয় দেন, তাদের খাবার দেন, বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন। তার পরিবারও জীবন ঝুঁকিতে থাকা এসব ছাত্রদের সুরক্ষা দেয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার ছেলে ব্যক্তিগত টাকায় এক ছাত্রকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন।
এই ঘটনা জানতে পেরে আমি গভীরভাবে আবেগাপ্লুত হই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র যখন এ গল্প আমাকে বলেন, তখন তার চোখ জলে ভরে ওঠে। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘স্যার, সেই মা আমাকে বাঁচিয়েছেন, না হলে আমার জীবন হুমকির মুখে পড়ত।’
আমি তাকে বললাম, ‘বাবা, তুমি কি সেই বাড়িটি চিনতে পারবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার, চিনতে পারব।’ তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা সেই মাকে কৃতজ্ঞতা জানাব।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা তার জন্য একটি বিশেষ উপহার তৈরি করলাম—একটি ছবি, যা স্মৃতিস্বরূপ থাকবে। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দলসহ তার বাড়িতে গেলাম। তিনি আমাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে বললাম, ‘আপনার মতো মায়েরা আমাদের সন্তানদের বিপদের দিনে পাশে না থাকলে হয়তো অনেক প্রাণ অকালে ঝরে যেত।’
তিনি এ উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত হলেন। আমরা অনুভব করলাম, দেশের নানা প্রান্তে হয়তো আরও অনেক মা-বাবা ছিলেন, যারা এভাবেই ছাত্রদের রক্ষা করেছেন, কিন্তু তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবু আমরা তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
লেখক: উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta