শঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের অভাবে জাতিসংঘ খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক করার পরিকল্পনা করেছে। সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের খাবারের বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা উদ্বিগ্ন, কারণ তারা মনে করছেন যে সাহায্য বন্ধ হলে সংকট আরও বাড়বে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, সাহায্য বন্ধ হলে তারা কোথায় যাবে। রয়টার্সের বৃহস্পতিবারের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
রয়টার্স জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এক রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৬ মাস বয়সী শিশুসহ বসে থাকা মাজুনা খাতুন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘এই সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব?” তিনি তার শিশুর চিকিৎসা নিয়ে চিন্তিত, কারণ তার সন্তান ক্লাবফুটের জন্য চিকিৎসাধীন। একদিকে মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে তাদের চাকরি বা শিক্ষার সুযোগ সীমিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিদেশি সাহায্য কমিয়ে দেয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী মানবিক খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, সহায়তা বন্ধের ফলে শরণার্থীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন, কারণ তারা মনে করছেন খাদ্য, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংকট আরও গভীর হবে। ২৪ বছর বয়সী রোহিঙ্গা সাদেক বলেন, ‘‘ডাক্তারের সংখ্যা কমে গেছে, স্বেচ্ছাসেবীদের বরখাস্ত করা হয়েছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।”
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রদান করেছে, ২.৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু তহবিল স্থগিত করার কারণে অনেক হাসপাতাল তাদের সেবা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, পাঁচটি হাসপাতাল তাদের সেবা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান জানিয়েছেন, ১১টি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রসহ ৪৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে অনেক রোহিঙ্গা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অগ্রাধিকার হল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের সুরক্ষা, বিশেষ করে নারী, মেয়ে ও শিশুদের।”
কক্সবাজারে এনজিও কার্যক্রম তদারকি করা ডেভিড বাগডেন বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা সংকটে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাস এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, গুল বাহারের চার বছরের মেয়ে মুকাররামা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। বাহার বলেছেন, ‘‘যদি এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমার মেয়ে তার অর্জিত চিকিৎসার সুবিধাগুলো হারাবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেছেন যে, খাদ্য সহায়তার কমানোর ফলে শরণার্থীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তহবিলের অভাবে তারা আগামী এপ্রিল থেকে রেশন অর্ধেক কমিয়ে ৬ ডলার করে দিতে বাধ্য হতে পারে। গত বছর রেশন কমিয়ে ৮ ডলার করা হলে ক্ষুধা ও অপুষ্টি বেড়ে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গা শরণার্থী নজির আহমেদ জানিয়েছেন, ‘‘আমরা যা রেশন পাই, তা খুবই কম। যদি তা আরও কমিয়ে দেয়া হয়, অপরাধ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু করবে।” পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, যার অন্যতম কারণ ছিল খাবারের অভাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বলেন, ‘‘অর্থ সাহায্য কমানোর ফলে পাচার, মৌলবাদ এবং শোষণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।” রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘‘আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি বিশ্বের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।”
শফিউল ইসলাম, যিনি পাঁচ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে আহত হন, শয্যাশায়ী অবস্থায় পুনর্বাসন কেন্দ্রের সাহায্য পাচ্ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যদি এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, আমার জন্য কোনো ভবিষ্যত থাকবে না।”
প্রকাশিত: | By Symul Kabir Pranta